কানাডা বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ এবং এটি তার উন্নত জীবনযাত্রা, শিক্ষা এবং চাকরির সুযোগের জন্য পরিচিত। প্রতিবছর লক্ষাধিক অভিবাসী কানাডার বিভিন্ন সেক্টরে কাজের সুযোগ গ্রহণ করেন।
উন্নত জীবনযাত্রা, উচ্চ বেতন এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা কানাডাকে অভিবাসীদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তাই অনেক পেশাজীবীর জন্যই পছন্দের স্থান কানাডা।
কিন্তু কানাডায় কোন কাজগুলোর চাহিদা বেশি এবং তাদের বেতন কাঠামো কেমন, তা জানা কর্মজীবনের সঠিক পরিকল্পনা করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কানাডায় যেসব কাজের চাহিদা বেশি
কানাডার কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু পেশার প্রতি প্রচুর চাহিদা দেখা যায়। দক্ষ ও অদক্ষ দুই ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই প্রচুর সুযোগ রয়েছে। পছন্দের পেশার জন্য দক্ষতা অর্জন করলে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
বিশেষ করে বর্তমান সময়ে প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা, নির্মাণ এবং সেবামূলক খাতে কানাডায় কাজের সুযোগ সবচেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্যসেবা পেশাজীবী: রেজিস্টার্ড নার্স, ফার্মাসিস্ট, ফিজিওথেরাপিস্ট। স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা সবসময়ই বেশি। অভিজ্ঞ নার্স ও ডাক্তারদের জন্য বেতনের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উল্লেখযোগ্য।
প্রযুক্তি ও আইটি: সফটওয়্যার ডেভেলপার, ওয়েব ডিজাইনার, ডেটা বিশ্লেষক। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কানাডার চাহিদা অত্যন্ত বেশি। প্রোগ্রামিং, অ্যাপ্লিকেশন উন্নয়ন এবং আইটি প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দক্ষতা থাকলে এই খাতে কাজ পাওয়া সহজ।
নির্মাণ ও প্রযুক্তিগত কাজ: ইলেকট্রিশিয়ান, ছুতার, ওয়েল্ডার, প্লাম্বার। এই ধরনের বিশেষায়িত কাজে অভিজ্ঞ হলে কানাডায় অনেক কাজের সুযোগ রয়েছে। এবং দক্ষতার সাথে এসব কাজ করতে পারলে অনেক বেশি উপার্জন করা সম্ভব।
পরিবহন ও লজিস্টিকস: ট্রাক ড্রাইভার, ডেলিভারি কর্মী। নির্মাণ এবং পরিবহন খাতের চাহিদা বর্তমানে শীর্ষে। ট্রাক ড্রাইভার এবং ইলেকট্রিশিয়ানের মতো পেশায় প্রশিক্ষিত শ্রমিকরা দ্রুত চাকরি পান।
খুচরা ও সেবা খাত: বিক্রয় প্রতিনিধি, গ্রাহক সেবা কর্মকর্তা এ ধরনের কাজগুলো খুচরা ও সেবা খাত নামে পরিচিত। এসব কাজেও কানাডায় প্রচুর কাজের সুযোগ রয়েছে। এবং বেতনের পরিমাণও গড়ে অন্যান্য কাজের তুলনায় অনেক বেশি।
মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং হিসাবরক্ষক: ব্যবসা এবং অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখানোর জন্য এই পেশাগুলোতে চাহিদা বেশি। হিসাবরক্ষক, আর্থিক বিশ্লেষক এ ধরনের কাজগুলো এই ক্যাটাগরির আওতাভুক্ত।
কাজের এই তালিকায় প্রবাসী ও স্থানীয়দের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে। প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগ অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হতে পারে। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, পেশা নির্ধারণ করলে দ্রুত সফল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
কানাডায় কোন কাজের বেতন বেশি:
কানাডায় কাজের বেতন পেশাভেদে ভিন্ন হয়। দক্ষ পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে উচ্চ বেতন এবং দ্রুত পদোন্নতির সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে।
নিচে কয়েকটি উচ্চ বেতনের কাজ এবং তাদের বেতনের পরিসীমা উল্লেখ করা হলো:
রেজিস্টার্ড নার্স: মাসিক বেতন প্রায় $৬,৫০০–$৯,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার CAD।
সফটওয়্যার ডেভেলপার: মাসিক বেতন প্রায় $৭,৫০০–$১০,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন ৯০ হাজার CAD থেকে ১২০,০০০ CAD।
মার্কেটিং ম্যানেজার: মাসিক বেতন প্রায় $৭,০০০–$১০,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন ৭০,০০০ কানাডিয়ান ডলার থেকে ১০০,০০০ CAD পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ডাটা অ্যানালিস্ট: আনুমানিক মাসিক বেতন প্রায় $৬,০০০–$৯,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন ৮৫,০০০ CAD থেকে ১১০,০০০ CAD।
ট্রাক ড্রাইভার: মাসিক বেতন $৫,৫০০–$৮,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন ন্যূনতম ৫০,০০০ CAD থেকে ৮০,০০০ CAD।
শেফ এবং কুক: অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে মাসিক ন্যূনতম ১-২ লাখ টাকা। তবে অভিজ্ঞ শেফদের বেতন ৪,৫০০ CAD থেকে ৬,৭৫০ CAD পর্যন্ত হয়ে থাকে। এবং গড় বার্ষিক আনুমানিক বেতন ৫৬,০০০ থেকে ৮৫,০০০ CAD পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ফার্মাসিস্ট: মাসিক বেতন $৬,৫০০–$৮,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন $৮০,০০০ CAD থেকে ১১০,০০০ CAD পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ফিন্যান্স ম্যানেজার: ন্যূনতম মাসিক বেতন $৬,৫০০–$১১,০০০ CAD/মাস। এবং গড় বার্ষিক বেতন $৯০,০০০ CAD থেকে ১৩০,০০০ CAD পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ওয়েল্ডার: ওয়েল্ডিং কাজে বেতন দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। যে যত বেশি দক্ষ তার বেতন তত বেশি। সাধারণত মাসিক বেতন $৩,৫০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ $৬,০০০ CAD/মাস হয়ে থাকে। এবং গড় বার্ষিক বেতন $৪৫,০০০–$৭০,০০০ CAD।
এই সকল কাজে উন্নত দক্ষতা বা বিশেষায়িত জ্ঞান থাকলে বেতন আরও বেশি হতে পারে।
কানাডায় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বেতন কত:
কানাডার সর্বনিম্ন বেতন সরকার দ্বারা নির্ধারিত হয়, যা প্রদেশ এবং অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়। আর বেতনের পরিমাপ করা হয় ঘণ্টা হিসেবে। অর্থাৎ কত ঘণ্টা কাজ করা হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে বেতন দেওয়া হয়ে থাকে।
কানাডায় বেতন প্রতি ঘণ্টায় $১৫ কানাডিয়ান ডলার থেকে শুরু হয়, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১,২০০ টাকার সমান।
যেহেতু কাজের ধরনভেদে বেতনের পরিমাণ ভিন্ন হয়ে থাকে, তাই কানাডায় যেকোনো কাজের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রতি ঘণ্টায় $১২.৭৫ থেকে $১৬.৭৭ CAD-এর মধ্যে হয়ে থাকে।
আর অধিক কর্মদক্ষতা থাকলে মজুরি বেশি পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ঘণ্টা প্রতি $৩৪.৩৫ CAD পর্যন্ত বেতন নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
প্রদেশভেদে কানাডায় সর্বনিম্ন বেতন:
- কানাডার নুনাভুট অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১৬ কানাডিয়ান ডলার।
- কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১৬.৭৫ কানাডিয়ান ডলার।
- কানাডার অন্টারিও অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১৬.৫৫ কানাডিয়ান ডলার।
- কানাডার আলবার্টা অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১৫ কানাডিয়ান ডলার।
- কানাডার কুইবেক অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১৫.২৫ কানাডিয়ান ডলার।
- কানাডার ম্যানিটোবা অঞ্চলে ঘণ্টাপ্রতি সর্বনিম্ন বেতন $১২.৭৫ কানাডিয়ান ডলার।
কাজের ধরনভেদে কানাডায় মাসিক বেতন কত:
মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় পেশা, অভিজ্ঞতা এবং কর্মঘণ্টার ওপর। সাধারণত, প্রতি মাসে ১৬০ ঘণ্টা কাজের ভিত্তিতে গড় আয় নির্ধারণ করা হয়। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য পেশা এবং তাদের গড় মাসিক বেতনের তালিকা দেওয়া হলো:
- কানাডায় ইলেকট্রিশিয়ানদের মাসিক বেতন ৫ লক্ষ টাকা থেকে ৮ লক্ষ টাকা।
- কানাডায় পুলিশ অফিসারদের মাসিক বেতন ৬,৫০,০০০ – ৮,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় রেস্টুরেন্ট ম্যানেজারদের মাসিক বেতন ৪,০০,০০০ – ৬,০০,০০০ টাকা।
- কানাডায় কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভদের মাসিক বেতন ৩,৫০,০০০ – ৫,০০,০০০ টাকা।
- কানাডায় কনস্ট্রাকশন শ্রমিকদের মাসিক বেতন ৪,৫০,০০০ – ৬,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় হেয়ারড্রেসারদের মাসিক বেতন ৩,০০,০০০ – ৫,০০,০০০ টাকা।
- কানাডায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের মাসিক বেতন ৫,০০,০০০ – ৭,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় ক্লিনারদের মাসিক বেতন ৩,০০,০০০ – ৩,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় প্লাম্বারদের মাসিক বেতন ৫,০০,০০০ – ৭,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় শিক্ষকদের মাসিক বেতন ৬,০০,০০০ – ৮,৫০,০০০ টাকা।
- কানাডায় গ্রাফিক্স ডিজাইনারদের মাসিক বেতন ৪,৫০,০০০ – ৭,০০,০০০ টাকা।
- কানাডায় ওয়েব ডেভেলপারদের মাসিক বেতন ৫,৫০,০০০ – ৯,০০,০০০ টাকা।
কানাডার কাজের ভিসার প্রকারভেদ:
কানাডায় কাজের জন্য বিভিন্ন ভিসা ক্যাটাগরি রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:
- ওয়ার্ক পারমিট ভিসা: দক্ষ ও অদক্ষ কর্মীদের জন্য জনপ্রিয় ভিসা।
- এক্সপ্রেস এন্ট্রি ভিসা: উচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কাজের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য।
- স্টাডি পারমিট (স্টুডেন্ট ভিসা): পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের সুযোগ।
আরো পড়ুন:
- কানাডা যাওয়ার জন্য ১০ টি নির্ভরযোগ্য এজেন্সি
- কানাডা যেতে IELTS কত পয়েন্ট লাগে
- কানাডা যাওয়ার খরচ কত
সর্বশেষ কিছু কথা
কানাডায় কাজের সুযোগ ও বেতন কাঠামো অভিবাসীদের জন্য একটি বড় আকর্ষণ। তবে, কাজ পাওয়ার আগে নির্ধারিত যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকা জরুরি।
কানাডায় কাজের সুযোগের অভাব নেই। তবে সঠিক পেশা এবং ভিসার ধরন নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজের চাহিদা, বেতন কাঠামো এবং ভিসার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকলে অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে।
সর্বাধিক জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন:
কানাডা ভিজিট ভিসায় গিয়ে কী কী কাজ করা যায়?
ভিজিট ভিসায় মূলত কাজ করার অনুমতি নেই। তবে, কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সীমিত সময়ের জন্য কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। যেমন: সম্মেলনে যোগদান, ব্যবসায়িক যোগাযোগ তৈরি করা, এ ধরনের নন-প্রফিট কাজগুলো করার অনুমতি রয়েছে।
কানাডা স্টুডেন্ট ভিসায় কী কী কাজ করা যায়?
কানাডা স্টুডেন্ট ভিসায় কাজ করার অনুমতি রয়েছে, তবে এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্টুডেন্ট ভিসায় অধ্যয়নের পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করার অনুমতি থাকে। যেসব কাজ করা যায় সেগুলো হচ্ছে:
* ক্যাম্পাসে বা বাইরে সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা।
* ছুটির সময় পূর্ণকালীন কাজ।
* স্টাডি প্রোগ্রাম সংশ্লিষ্ট ইন্টার্নশিপ।
কানাডায় শ্রমিকদের বেতন কত?
শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বেতন কাজের ধরন এবং অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। গড়ে মাসিক বেতন প্রায় ১-২ লাখ টাকা। দক্ষ শ্রমিকদের বেতন $৫,০০০–$৭,৫০০ CAD/মাস।
কানাডায় যেতে আইইএলটিএস (IELTS) স্কোর কত লাগে?
কানাডায় যেতে সাধারণত IELTS স্কোর ৬.০ বা তার বেশি প্রয়োজন হয়। তবে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের জন্য স্কোর ভিন্ন হতে পারে।
কানাডায় যেতে কত টাকা লাগে?
কানাডায় যাওয়ার খরচ $৪,০০০–$১০,০০০ CAD, ভিসার ধরন অনুযায়ী। বাংলাদেশি টাকায় কানাডায় যাওয়ার জন্য সর্বমোট ৯ থেকে ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে।
কানাডা ভিসা আবেদনের নিয়ম কী?
অনলাইনে আবেদন করা যায়। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা দিয়ে নির্ধারিত সময়ে আবেদন সম্পন্ন করতে হয়। আবেদন প্রক্রিয়ায় পাসপোর্ট, ছবি, আইইএলটিএস স্কোর, এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।
কানাডা ভিসার দাম কত?
কানাডা ভিসার আবেদন খরচ প্রকারভেদে $১৫০–$৫০০ CAD। তবে ভিসা হাতে পাওয়ার জন্য সর্বমোট সরকারিভাবে প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা এবং বেসরকারিভাবে ৬-৭ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। তবে কানাডার ওয়ার্ক পারমিট ভিসার খরচ সব মিলিয়ে সাধারণত ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে পড়ে।